লাইভ নারায়ণগঞ্জ:আজ ৪ ঠা এপ্রিল। ১৯৭১ সালের এই দিনে নারায়ণগঞ্জের বন্দরে কমপক্ষে ৫৬ জনকে হত্যা করে পাকিস্থানী সেনাবাহিনী। হত্যার পর লাশ পুড়িয়ে দেয়া হয় গানপাউডার দিয়ে। ২৫ মার্চ সন্ধায় নারায়ণগঞ্জের বন্দরের সিরাজ-উদ-দৌলা ক্লাব মাঠে বাঙ্গালীর স্বাধীকার আন্দোলন নিয়ে ‘অমর বাঙ্গালী’ নাটক মঞ্চস্থ হয়। যে নাটকে জয় বাংলা স্লোগান দেয়া হয়। নাটক দেখে উপস্থিত জনতাও জয় বাংলা স্লোগান দেয়। এ অপরাধে সিরাজ-উদ-দৌলা ক্লাব মাঠের পার্শ্ববর্তী বাড়িঘরে গনহত্যা চালায় পাকিস্থানী বাহিনী।
নারায়ণগঞ্জের বন্দরের সিরাজউদ্দৌলা ক্লাবের বয়স ৭০ বছর। নারায়ণগঞ্জের টিকে থাকা সবচেয়ে পুরনো সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলির একটি হিসেবে ধরা হয় সিরাজ-উদ-দৌলা ক্লাবকে। এ ক্লাবের তরুন নাট্যকর্মী শফিউল্লাহ মিয়া বাবু জানান, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষনের পরে সাড়াদেশ স্বাধীনতার দাবীতে উত্তাল হয়ে ওঠে। ২৫ মার্চ সন্ধায় বাঙ্গালীর স্বাধীকার আন্দোলন নিয়ে ‘অমর বাঙ্গালী’ নামের একটি নাটক মঞ্চস্থ হয় এই সিরাজ-উদ-দৌলা ক্লাব মাঠে। নাটকটির রচয়িতা ছিলেন আব্দুস সাত্তার ভূইয়া আর নির্দেশনায় ছিলেন আমার বাবা এস এম ফারুক মিয়া। নাটকটি পুরো-ই ছিলো পাকিস্থানীদের শোষনের বিরুদ্ধে। নাটকটি দেখতে সিরাজ-উদ-দৌলা ক্লাব কানায় কানায় পূর্ন করে কয়েক হাজার মানুষ উপস্থিত ছিলো। নাটকে জয় বাংলা স্লোগান ছিলো। এই স্লোগান শুনে উপস্থিত দর্শকরাও জয় বাংলা স্লোগান দেয়। নাটক শেষ হলে আমরা জানতে পারি ঢাকায় গনহত্যা শুরু হয়ে গেছে। ৪ এপ্রিল ভোর রাত সাড়ে তিনটায় পাকিস্থানী বাহিনী বন্দরে ঢুকেই মাঠের চারিদিকের বাড়িগুলিতে হামলে পড়ে। যারা পালিয়ে না গিয়ে কিছু হবেনা ভেবে অবস্থান করছিলো তাদের সবাইকে ধরে আনে। মেয়েদের ধর্ষন করে। মাঠে লাইন ধরে দাড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করে। এখানে গর্তে ফেলে দিয়ে গান পাউডার দিয়ে লাশ জ্বালিয়ে দেয়।
মাঠের পাশের বাসিন্দা বাহাউদ্দিন খান জানান, আমার ভাই বাদশাহ খানকে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে মেরে ফেলা হয়। সকালে ভাইয়ের লাশ আলাদা করে বুঝতে পারিনি। সব পোড়া লাশ স্তুপ হয়ে ছিলো। কারো হয়তো একটু পা পোড়েনি, কারো পেটের একটু অংশ পোড়েনি, এসব দেখে অনেকে আত্মীয়-স্বজনের লাশ চিনেছে। আমরা চিনতে পারিনি। আমি ভালো ছাত্র ছিলাম। ক্লাসে এক দুই রোল নাম্বার থাকতো। বড় ভাই আমাদের পরিবারের আয়ের উৎস ছিলেন। বড় ভাই মরে যাওয়ায় পড়া বন্ধ করে ছোটবেলায়ই কাজে গেছি। যখন মানুষে বলে তুই কি পাশ, তখন বুক ফেটে কান্না আসে।
মাঠের আরেক প্রান্তের বাসিন্দা সুশান্ত কানু বলেন, আমি কোনো রকমে পালিয়ে গেছিলাম। আমার পিতা কানাই লাল কানু, বড় তিন ভাই লসমন কানু, যমুনা কানু, সরজু কানু আমাদের দুই ভাড়াটিয়া দূর্গা প্রসাদ আর নারায়ণ প্রসাদকে ধরে নিয়ে ব্রাশ ফায়ার করে হত্যা করে । লাশ গান পাউডার দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়া হয়। এখানে ৫৬ জনকে হত্যা করে। তবে এখান থেকে গিয়েও আরো অনেককে হত্যা করে লাশ নদীতে ফেলে দেয়। সবাই যেহেতু সেসময় পালিয়ে গিয়েছিলো কেউ সঠিকভাবে হিসাবটা বলতে পারেনা।
এ বধ্যভূমিতে নিহতদের হাড় নিজের কাছে যতœ করে রেখেছেন মুক্তিযোদ্ধা কাজী ইসরাফিল। তিনি বলেন, যখন নতুন প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে বা তাদের সন্তানদের নিয়ে কটুক্তি করে কথা বলে তখন খুব কষ্ট পাই। এই হাড়গুলি দেখিয়ে তাদের বলি, দেখো যদি মুক্তিযোদ্ধারা নিজেদের জীবন বিপন্ন করে যুদ্ধে না যেতো তাহলে এভাবে আরো কতো মানুষকে তারা হত্যা করতো, আরো কতবার যে এদেশে গনহত্যা হতো তার হিসাব থাকতো না। এই পৃথিবীতে গনহত্যায় বহু জাতি ধ্বংস হয়ে গেছে। বহু জাতি এখনো যুদ্ধ করছে স্বাধীনতা পায়নি। শুধু আমরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মতো নেতা পেয়েছিলাম, মুক্তিযোদ্ধাদের পেয়েছিলাম পুরো দেশবাসির সমর্থনও ছিলো -এসব মিলিয়ে দেশে স্বাধীনতা এসেছে। নইলে আসতো না।
গনহত্যা দিবসে নিহতের স্বজনরা আয়োজন করেছেন মিলাদ, দোয়া মাহফিল।