স্টাফ করেসপন্ডেন্ট, লাইভ নারায়ণগঞ্জ: ২২ মার্চ রাত সাড়ে ৭টায় ফতুল্লার রামারবাগ এলাকায় দুই গ্রুপের সংঘর্ষ। এক পর্যায়ে গুরুত্বর আহত হয়ে রাস্তায় লুটিয়ে পরে নাজমুল নামের এক ব্যক্তি। এ দৃশ্য দেখে আহত নাজমুলকে নিয়ে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে রওনাদেন একই এলাকায় বসবাসরত রাজমিস্ত্রী আল-আমিন। নাজমুলের সাথে আল-আমিন হাসপাতালে গিয়েছিলো ঠিকই! কিন্তু নিজের পায়ে ভর করে নয়, বেডে শুয়ে।
প্রতক্ষদর্শীরা জানান, প্রতিদিনের মতো সেদিনও সব কিছু ঠিক ঠাক চলছিলো। কেউ বসে আছে, চায়ের দোকানে, কেউ ব্যস্ত সময় পাড় করছিলো বেচা কিনায়। কিন্তু হঠাৎই সব পাল্টে গেলো। মুরাদ, রাজিব, সজিব, দেলওয়ারের নেতৃত্বে প্রায় শতাধিক চেনা অচেনা ব্যক্তি লাঠি সোটা ও অস্ত্র নিয়ে মারধর শুরু করলো যার যাকে খুশি। শান্ত রামারবাগ এলাকা মুহুতেই পরিনত হলো আতঙ্কের নগরীতে। কয়েক মিনিটের মধ্যে কেউ মার খেয়ে পালিয়ে বাচঁলো, কেউ রাস্তায় পড়ে রইলো লুটিয়ে। ভয়ের কাছে হার মানলো মানবতা। কেউ কাউকে উদ্ধার করার সাহস টুকুও পাচ্ছিলো না। হঠাৎ সবাইকে অবাক করে আহত নাজমুলকে নিয়ে হাসপাতালের উদ্দ্যেশে রওনা হয় রাজমিস্ত্রী আল আমিন। কিন্তু কিছু ক্ষন পর রামারবাগে খবর আসলো তাকেও কেউ মেরেছে।
কাঠেরপুল এলাকার নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক ব্যক্তি জানান, আল-আমিন যখন আহত নাজমুলকে নিয়ে যাচ্ছিলো হাসপাতালের উদ্দেশ্যে। তখন গিয়াসউদ্দিন ও আজমত গ্রুপের কিছু লোক কাঠেরপুল এলাকায় তাদের পথ আগলে ধরে। গাড়িটি আটকে আহত নাজমুলের উপর আবারও হামলার চেষ্টা করে। এসময় রাজমিস্ত্রী আল আমিন বাধাঁ দিলে প্রথমে তার পা ইট দিয়ে থেতলে দেওয়া হয়। পরে আহত নাজমুলকে জনসম্মুখেই হাত ও পায়ের রক কাটা হয়েছিলো।
বর্তমানে রাজমিস্ত্রী আল-আমিন চিকিৎসাধীন রয়েছে। আর নাজমুল রয়েছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের আইসিইউতে। এখনও নিজের পায়ে ভর করে দাঁড়াতে পাড়ছে না আল-আমিন। সেদিনের সেই নির্মম ঘটনা জিজ্ঞাস করলেই উত্তরে শুধু চোখের জল ফেলছে। তার যেন কথা বলার ভাষা নেই।
কি ভাবে শুরু হয় সংঘর্ষ:
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের শুরু থেকে মূলত বিরোধ সৃষ্টি হয় আজমত-গেসুর বাহিনীর সাথে ও মোস্তফার লোকজনের মধ্যে। দীর্ঘদিন ধরে ফতুল্লার কাঠেরপুল, কুতুবাইল, শিবুমার্কেট, লালখাঁ, লামাপাড়া ও রামারবাগ এলাকার একক নিয়ন্ত্রণ আজমত গ্রুপের। ছিলো জেলা ও মহানগর আওয়ামীলীগের শীর্ষ নেতাদের সাথে সু-সর্ম্পক থাকার খ্যাতিও।
আজমত আলী গ্রুপের সাথে থাকা সাবেক এক সহযোগী জানান, এলাকাগুলোতে গড়ে উঠা গার্মেন্সের জুট, জমির বেচাকিনা, ডিস ব্যবসাসহ নানা কর্মকান্ডের বিচার আচারের মধ্য দিয়ে মাসে প্রায় পৌনে ১ কোটি টাকা যেতো আজমত-গেসু দুই ভাইয়ের পকেটে। এবারের নির্বাচনে স্থানীয় সাংসদের সাথে মোস্তফা কামালের সাথে সক্ষতা গড়ে উঠায় আজমত আলী ও গিয়াসউদ্দিনরা চিন্তিত হয়ে পরে। তাই মোস্তফা কামালের কোন মিটিং মিছিলে লোকজনকে যেতে বাঁধাদেয় গ্রুপটি। এ নিয়ে ধীরে ধীরে রূপ নেয় আধিপত্য বিস্তারের ২২ মার্চের সংঘর্ষ। যদি সময় মতো পুলিশ ও র্যাব না আসতো তাহলে লাশও পড়তে পারতো সেই দিনের সংঘর্ষে।
এদিকে ২৩ মার্চ ২৫ জনের নাম উল্লেখ করে ৫৫ জনের বিরুদ্ধে ফতুল্লা মডেল থানায় একটি মামলা দায়ের করে লামাপাড়া এলাকার মৃত মফিজ উদ্দিনের ছেলে আব্দুল গফুর। মামলায় এজহারে উল্লেখ করা হয়, আজমত আলী ও গিয়াসউদ্দিনরা এলাকায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে দীর্ঘদিন যাবৎ শত্রুতা করে আসছিলো। সেই শত্রুতার জের ধরে রাত সাড়ে ৭টায় পূর্ব পরিকল্পিত ভাবে দেশি অস্ত্র দিয়ে এলোপাতাড়ী হামলা করে। এক পর্যায়ে মাথায় গুরুতর জখম করে। এসময় আরো ১৫ জনের বেশি মানুষকে মারধর করে প্রতিপক্ষের লোকজন। রামারবাগ মসিজিদের পাশের বেশ কিছু চালের আড়ৎ ও দোকানে প্রায় হামলা চালিয়ে প্রায় ১ কোটি কাটার ক্ষয়ক্ষতি সাধন করা হয়।
যদিও এলাকাবাসী বলছে, মারামারির এক পর্যায়ে দুই গ্রুপই সংঘর্ষে ঝড়িয়ে পড়েছে। কয়েক দফা ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া হয়। এতে উভয় পক্ষের লোকজন আহত হলেও গুরুতর আহতের সংখ্যা বেশি মোস্তফা কামাল সমর্থকদের। প্রথম পর্যায়ে আচমকা হামলার সময়ই বেশ কিছু লোক বেশি আহত হয়।
এখন আতকে উঠে শিশুরা:
সে দিনের সংঘর্ষের পর থেকেই মহল্লাটিতে এখনও সেই থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, আড়ালে আবডালে দাঁড়িয়ে আশপাশের পরিচিত মানুষ গুলোর কাছে জানতে চাইছে সংঘর্ষের বতর্মান অবস্থান। অপরিচিত কেউ কিছু জানতে চাইলে বলতে চাইছে না কেউ।
অনেকের সাথে কথা বলার ব্যর্থ চেষ্টার পর স্থানীয় এক শিক্ষক জানান, এখন সেই দিনের ঘটনায় সামান্য হৈ চৈ শুনলে শিশুরা ভয়ে আতকে উঠে। আর বড়রা কিছু বললেও সেটা অনেকটা কানে মুখে বলার অবস্থা।
বর্তমানে যে অবস্থায় আছে মামলাটির:
২২ মার্চে ফতুল্লার রামারবাগ এলাকায় আজমত আলী ও গিয়াসউদ্দীন গ্রুপের সাথে মোস্তাফা গ্রুপের সংঘর্ষের ঘটনায় আজমত ও গিয়াসউদ্দিন গ্রুপের রাজিব ও হোসেনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আজ ২৭ মার্চ দুপুরে মামলার শুনানিতে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ৭ দিনের রিমা-ে চেয় উঠানো হলে আদালত রাজিবের ১ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন। এছাড়া আসামী হাসানকে ফের কারাগারে প্রেরণ করেন।
এসময় মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ফতুল্লা মডেল থানার ইনপেক্টার মো. আজিজুল হক আদালতকে জানান, প্রাথমিক তদন্তে বাদির অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে। আসামীরা সন্ত্রাসী প্রকৃতির লোক। তাদের ভয়ে এলাকার মানুষ অতিষ্ঠ, মুখ খোলার সাহস পর্যন্ত পায় না। তাদের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ প্রমানের মতো যথেষ্ঠ সাক্ষ প্রমান পাওয়া যাচ্ছে।